ঈদ শুধু উৎসব নয়, ঈদ মানেই স্বজন-পরিজনের সম্মিলন। আর এই সম্মিলনের আশায় প্রতি বছরের মতো জীবিকার তাগিদে প্রিয়জনদের ছেড়ে বন্দর নগরীতে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষ শহরের কোলাহল ছেড়ে আপন নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে।
এবার দীর্ঘ ছুটি থাকায় অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। তাই স্বজনদের সঙ্গে বাড়িতে স্বস্তিতে ঈদ করার আনন্দ ভাগ করতে গ্রামে ফেরার আয়োজনে ব্যস্ত নগরবাসী।
তাই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে আজও বাড়ির পথে ছুটছেন হাজার হাজার নগরবাসী। এতে সকাল থেকেই সড়ক ও রেলপথে দেখা গেছে ঘরমুখী মানুষের ঢল।
এখন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে শহর। শুক্রবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের রেলওয়ে স্টেশন ও গুরুত্বপূর্ণ বাসস্টপেজগুলোতে ঘরমুখো মানুষের চাপ লক্ষ্য করা গেছে। শুক্রবার রাতে ট্রাক-পিকআপে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেককে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে।
তবে এবার চট্টগ্রাম থেকে ঈদযাত্রায় ট্রেনের টিকিট পেতে বিড়ম্বনা ছিল না। পরিবহনগুলোর বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের খুব বেশি অভিযোগও ছিল না যাত্রীদের। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার ঈদযাত্রা অনেকটা স্বস্তিদায়ক বলে মনে করছেন ঘরমুখো মানুষ।
ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাসস্টপেজগুলোতে: গেল কয়েকদিন ধরে ঘরমুখো মানুষের পদচারণায় মুখর চট্টগ্রামের অলংকার মোড়, অক্সিজেন, মুরাদপুর,বহদ্দারহাট, কদমতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, কদমতলী বাস টার্মিনাল, স্টেশন রোড, বিআরটিসি বাসস্টেশন, গরিবুল্লাহ শাহ মাজার গেট, একে খান ও সিটি গেট এলাকার বাস কাউন্টারগুলো।
শুক্রবার ভোর থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ঘরমুখো মানুষের ভিড় বেশি ছিলো বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের বিভিন্ন রুটের যাত্রীবাহী বাসের প্রধান স্টেশন হিসেবে পরিচিত নগরীর কদমতলী, অলঙ্কার, সাগরিকা ও এ কে খান এলাকায়।
এসব স্টেশন থেকে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী ও ফরিদপুর অঞ্চলের বাসও ছেড়ে যায়। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কাপ্তাইয়ের বাস ছাড়ে অক্সিজেন, মুরাদপুর ও বহদ্দারহাট থেকে। কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বাস ছাড়ে নগরীর বাকলিয়া থানাধীন নতুনব্রিজ এলাকা থেকে।
শুক্রবার রাতে এবং শনিবার সকালে বিভিন্ন বাস স্টেশনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি ফেরা মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। প্রতিটি বাসে পর্যাপ্ত যাত্রী উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অনেক বাসের শিডিউলও মানা যাচ্ছে না। বেশ কিছু যাত্রীর মুখে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ শোনা গেলেও অধিকাংশ যাত্রীই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
স্বস্থিতে যাত্রী,ভোগান্তি কম : এবার ঈদে বাড়ি যেতে ঘরমুখো মানুষের ভিড় থাকলেও ভোগান্তি কম। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ঈদযাত্রা চলছে। বিভিন্ন বাস স্টপেজে অপেক্ষমান যাত্রীদের সাথে কথা হলে তারা জানায়, আর বেশি সময় বাকি নেই। সোমবার ঈদ। প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতেই শহর ছাড়ছেন তারা। যাত্রী সেবায় শিডিউল বিপর্যয় ও বাড়তি ভাড়া নিলেও এবার শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে অধিকাংশ যাত্রীই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বাস মালিক ও পরিবহণ নেতাদের বক্তব্য: বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে বাস মালিকরা বলেছেন, ফেরার পথে যাত্রীশূণ্য হয়ে ফিরতে হয় বাস, তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সামান্য ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
বাস স্টেশনে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও কোন ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যের বাস পাচ্ছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি খোরশেদ আলম।
তিনি বলেন, গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজারেরও বেশি যাত্রী পরিবহণ করছে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দ্যেশে বাসগুলো চট্টগ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. শাহজাহান বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের চাপ কিছুটা কম। লম্বা ছুটি হওয়ায় মানুষ ধাপে ধাপে বাড়ি যাচ্ছেন। মহাসড়কেও তেমন যানজটের খবর পাওয়া যায়নি।
বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে বিআরটিএ অভিযান পরিচালনা করছে, এতে সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ সহযোগিতা করছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও বিআরটিএর বক্তব্য: ইতিমধ্যে সিএমপি ও বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রী পরিবহন ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি পরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে। কয়েকটি পরিবহন জব্দও করা হয়।
শুক্রবার নগরীর বড়পোল ও কদমতলী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন বিআরটিএ চট্টগ্রামের আদালত-১১ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকারিয়া ও আদালত-১৩ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিকি মারমা।
অভিযানে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দায়ে বড়পোল এলাকার জোনাকি পরিবহনের কাউন্টারকে ১০ হাজার টাকা, শাহী পরিবহনের কাউন্টারকে ১০ হাজার টাকা এবং বসুরহাট এক্সপ্রেস কাউন্টারকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়াও কদমতলীতে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়ায় বাঁধন পরিবহনের কাউন্টারকে ১ হাজার টাকা এবং একই পরিবহনের ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় অতিরিক্ত ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
তাছাড়া বিআরটিএ ও সিএমপির পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রী পরিবহন না করতে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহন চালক-মালিকদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। যদি ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাত্রী পরিবহন করা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম আদালত-১১ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকারিয়া জানান, চট্টগ্রাম থেকে ঈদযাত্রায় যাত্রীরা যাতে হয়রানি বা ভোগান্তির শিকার না হন এবং কোনো পরিবহণ যাতে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে না পারে সে ব্যাপারে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এই অভিযান আজও অব্যাহত রয়েছে।
অবৈধ যান ও ট্রাফিক পুলিশের বক্তব্য : এদিকে প্রায় প্রতিটি রুটে যাত্রীর চাপ সামাল দিতে লক্কর-ঝক্কর বাস নামানোর অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে সিএমপির ট্রাফিক বন্দর বিভাগের পরিদর্শক (টিআই) প্রশাসন মো. মশিউর রহমান বলেন, অবৈধ যানবাহন নগরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে মামলা ও জব্দ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।
ঈদযাত্রায় রেলসেবা: শেখড়ের টানে বাড়ি ফিরতে ট্রেনের অপেক্ষায় যাত্রীর চাপও রয়েছে রেলওয়ে স্টেশনে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, গত ১৪ মার্চ (শুক্রবার) থেকে রেলওয়ে অগ্রিম টিকিটে শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। এরপর থেকে প্রতিটি ট্রেনে যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ। শুক্রবার রাতে এবং শনিবার ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর নতুন রেলওয়ে স্টেশনেও দেখা যায়, শহরের ব্যস্ততা ফেলে পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চট্টগ্রাম নগর ছাড়ছেন মানুষ।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অতিরিক্ত যাত্রীচাপ সামাল দিতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ থেকে অনেক মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
ইতিমধ্যে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই ট্রেনগুলো নিজ নিজ গন্তেব্যে যাচ্ছে। শিডিউলে কোনো ধরনের হেরফের হচ্ছে না। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন গন্তব্যে ১০টি আন্তঃনগর, চারটি মেইল ও ঈদ স্পেশালসহ ১৬ থেকে ১৮টি ট্রেন যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, এবার মোট ১৬টি আন্তঃনগর ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাবে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে এক জোড়া বিশেষ ট্রেন চলাচল করবে।
তিনি বলেন, রবিবার সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো স্মুথলি চলাচল করছে। কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। প্রতিদিন অগ্রিম টিকিটের ও স্ট্যান্ডিং টিকিটের যাত্রী মিলে ১২ হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহণ করা হচ্ছে।
শতভাগ অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় স্টেশনের কাউন্টারে ভিড়ের সেই চিত্র এখন আর নেই বললেই চলে।
ঈদযাত্রায় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা : ঈদযাত্রার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ বাড়ায় মাঝে মধ্যে দীর্ঘ যানজটের খবর পাওয়া গেলেও সড়কে দুর্ভোগ, যানজট-সব জঞ্জাল পেছনে ফেলে বাড়ি ফেরার অন্যরকম আনন্দ সবার চোখেমুখে।
পুলিশ প্রশাসনে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানায়, ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষকে স্বস্তি দিতে সিএমপি ও জেলা পুলিশের বিশাল একটি টিম নগর এবং মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়োজিত রয়েছেন। ঘরমুখো মানুষ যেন স্বস্তিতে গন্তব্য পৌঁছাতে পারে সেজন্য পুলিশ রাতদিন সড়ক-মহাসড়কে পরিশ্রম করছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাহমুদা বেগম বলেন, ‘মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে বাড়িতে যেতে পারেন, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধমূলক ঘটনা বা বিড়ম্বনার শিকার না হন, সেজন্য আমরা রমজানের শুরুতেই প্ল্যান করেছি।
রেলস্টেশন এবং বাস টার্মিনালগুলোতে আমাদের সার্বক্ষণিক টহল রয়েছে। সাদা পোশাকের পুলিশও নজরদারিতে রেখেছে।