27.1 C
Chittagong
মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
spot_img

― Advertisement ―

spot_img
প্রচ্ছদচট্টগ্রামভয়ংকর রূপের দিকে ডেঙ্গু,চাপ বাড়ছে হাসপাতালে

ভয়ংকর রূপের দিকে ডেঙ্গু,চাপ বাড়ছে হাসপাতালে

রাজীব প্রিন্স :

গেল কয়েক বছরের মতোই আবারও ভয়ংকর রূপের দিকেই যাচ্ছে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন নগর ও জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে।

এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি একাধিক হাসপাতালে বহু রোগী ইতিমধ্যে চিকিত্সাধীন রয়েছেন। আবার কেউ কেউ চিকিত্সকদের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিত্সা নিয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

গেল তিন বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে এই রোগের প্রকোপ চরম আকার ধারণ করে। আর সে সময়কালের ডেঙ্গুর ভয়ানক রুপের কথা মাথায় রেখে সাধারণ রোগীদেরও ভয় পেয়ে বসেছে মৃত্যুর। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে তারা শঙ্কিত।

চিকিত্সকরাও জানান, কোনো ডেঙ্গু রোগী দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হলে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গত বছরের বিপর্যয় মাথায় রেখে এখনই মশা নিধন কার্যক্রমে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকেও ডেঙ্গুর প্রভাব মোকাবিলায় এখনই মশা নিধনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন।

তবে কে করবে নিধন, ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন থেকে মশা নিধনে বিশেষ কোন কার্যক্রম এখনো চোখেই পড়ছে না নগরবাসীর।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম শুরু হয় জুন-জুলাই মাসে। প্রাদুর্ভাবের মৌসুম থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে গিয়ে সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। সবশেষ গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ডেঙ্গু নিয়ে নগরবাসীর মনে ইতিমধ্যেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ের ব্যবসায়ী নিরঞ্জন সরকার বলেন, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এখনই মশা নিধনের জোরালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন ১০৭ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮৭ জন।

তবে স্বসস্থির খবর হচ্ছে গত বছর এমন সময়ে ভয়ানক আকার ধারণ করলেও চলতি বছরের একই সময়ে এসে তুলনামূলক অনেক কম।

হত বছরের জুলাই মাসে এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৩শ ১১ জন। তাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিলো। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনজন। বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২৭৩।

তাঁদের মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম ১২ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৫ জন। জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪১ জন।

বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে ৬-৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। তার আগে কয়েক জন চিকিত্সা নিয়ে চলে গেছেন।

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন জানান, ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এখন থেকেই হাসপাতালে রোগী বাড়তে শুরু করেছে।

তবে এবার আগে ভাগেই আমরা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করেছি। ডেঙ্গু রোগীর চিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরীক্ষাসহ প্রস্তুতি নিয়েছি।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই চিকিত্সকদের শরণাপন্ন হয়ে চিকিত্সা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন ফৌজদারহাট বিআইটিআইডির সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশিদ।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, চলতি বছরের ডেঙ্গু প্রজণন মৌসুমে পরিসংখ্যানগতভাবে রোগীর সংখ্যা কম মনে হলেও বিপদ পরিপূর্ণভাবে এখনো কাটেনি।

তিনি বলেন, গত বছর আগাম বৃষ্টির কারণেই এডিস মশা বেড়েছে,আক্রান্তও বেশি হয়েছে। এবার একই সময়ে বৃষ্টি কম হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবও কম। তবে এখন বৃষ্টি বাড়ছে,আক্রান্তও বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

জেলা সিভিল সার্জন বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের এ বিষয়ে সতর্কতামূলক বার্তা দিয়েছে। আমরা উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু রোগী গেলে চিকিত্সা যেন দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।

তাছাড়া চট্টগ্রাম নগরের মশক নিধন কার্যক্রমের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি বলে মনে করেন সিভিল সার্জন।

তবে কোন নির্দেশনা কিংবা পরামর্শ, কোনটাই সংশ্লিষ্ট কর্তাদের কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। নীরব-চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও। অথচ এখন এডিস মশার প্রজননকালের চূড়ান্ত সময়। এ সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়ে।

সিটি করপোরেশনের এমন ‘নিষ্ক্রিয়’ অবস্থায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। আবার অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আছেন আতঙ্কে।

মশার কামড় থেকে বাঁচতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মশক নিধন কয়েল, ইলেক্ট্রিক ব্যাটসহ নানান কিছু ব্যবহার শুরু করেছে বাকলিয়া থানাধীন রাজাখালী এলাকার বাসিন্দা ফোরকান আবু। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বাড়তি এ খরচের বোঝা কিভাবে সামলাবে ভেবে কুল পাচ্ছে না সাধারণ এ চাকুরীজিবী।

নগরীর আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেইনের বাসিন্দা ব্যবসায়ী উত্তম সেন অভিযোগ করে বলেন, কেবল ডেঙ্গুর প্রকোপ চরম আকার ধারণ করলেই সিটি করপোরেশন মশা নিধনের তোড়জোড় শুরু করে।

কিন্তু ততক্ষণে ডেঙ্গুর আক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমলে তারা আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অথচ বছর জুড়ে মশা নিধনের কর্মসূচি চালু রাখলে কোনো ধরনের মশা এত পরিমাণে বৃদ্ধি পায় না।

কোতোয়ালী থানাধীন পাধরঘাটার বাসিন্দা ইউসুফ আলী জানায়, ওষুধ ছিটানোর জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে অনেকবার অনুরোধ করেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

জামালখানের বাসিন্দা গৃহিনী মিনারাও জানালেন ডেঙ্গু আতঙ্কের কথা। তিনি বলেন, দিন থেকে রাত প্রায় পুরো সময়টাতেই মশার উৎপাত। কামড় থেকে ছোট ছোট সন্তানদের গায়ে সবসময় লোশন দিয়ে দেয় এবং সার্বক্ষনিক মশারিও টানানো থাকে। তারপরও রক্ষা হচ্ছে না। এখন ভয় ঢুকেছে ডেঙ্গুর।

তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবী করছেন অন্যান্য বছরের তুলনায় তারা এবার অনেক বেশি তৎপর। ফলে রোগীর সংখ্যা কম।

এদিকে ডেঙ্গু নিয়ে চলতি মাসের শুরুতে চসিকে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হলেও সভার সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকে জানায়নি সংস্থাটি। তবে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম দু-একদিনের মধ্যেই শুরু হবে।

এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী বলেন, এডিস মশার বিস্তার রোধে গত বছরের তুলনায় এবার চসিক আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।

তিনি মশা নিধনের ওষুধের কোনো ঘাটতি নেই জানিয়ে বলেন, ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ক্রয় করা হয়েছে। তাছাড়া ৩ হাজার লিটার র-লার্ভিসাইড আছে। যা এক লিটার লার্ভিসাইড ৩ হাজার লিটার ওষুধে মিশিয়ে ব্যবহার সম্ভব।

তিনি বলেন, গতবার যেসব কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল, এবারও তা নেওয়া হবে। মশক নিধনে মশা মারার রুটিন কাজ অব্যাহত আছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হবে চসিকের প্রতিটি ওয়ার্ডে।

একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল পাঁচটি এলাকায়। বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও বায়েজিদ বোস্তামি। এসব এলাকাকে গবেষকেরা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী বলেন, ইতিমধ্যে হটস্পট চিহ্নিত করার কাজও শুরু হয়ে গেছে।

তবে ওষুধ ছিটানোর দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কিছুটা গাফিলতি এবং জনসচেতনতার অভাবে মশকনিধন কার্যক্রমে বড় ঘাটতি বলে মন্তব্য করেছেন মো. শরফুল ইসলাম।

এদিকে গত ৩০ মার্চ মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় জানতে এপ্রিলের মধ্যে গবেষণাগার চালু হবে। কিন্তু ঘোষণার সাড়ে তিন মাস পার হলেও এখনো তা চালু হয়নি।

ঘোষিত সে গবেষণাগারও আগামী মাসে চালু হবে জানালেন চসিক কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী।